আশার আলো কি নিভতে শুরু করেছে ইরানের? মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের যে আধিপত্য ছিল তা কি থাকবে আগের মতো?
গত সপ্তাহে বিদ্রোহীদের ঝড়ো আক্রমণে সিরিয়ায় পতন হয়েছে বাশার আল-আসাদের শাসন। তার পতনের পর দামেস্কে ইরানের দূতাবাসও ভাংচুরের শিকার হয়। মেঝেতে পদদলিত পতাকার মধ্যে পড়ে ছিল ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ছিঁড়ে যাওয়া পোস্টারও। গত সেপ্টেম্বরে বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহর ছেঁড়া ছবিও লুটিয়ে ছিল সেখানে।
বাশার আল-আসাদকে সাহায্য করতে এর আগেও ইরান এগিয়ে এসেছিল। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গণঅভ্যুত্থান গৃহযুদ্ধে রূপ নেওয়ার পর যখন তাকে (বাশার আল-আসাদ) দুর্বল বলে মনে হচ্ছিল, সেই সময় যোদ্ধা, জ্বালানি ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিল তেহরান।
ইরান কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখার পাশাপাশি ইসরায়েলি হামলার প্রতিরোধ করতে মিলিশিয়াদের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এটা ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকেই চলে আসছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানি দূতাবাসের বাইরের দিকটা সুদৃশ্য করার জন্য লাগানো ফিরোজা রঙের টাইলস অক্ষত ছিল। তবে ইরানের প্রভাবশালী বাহিনী রেভোল্যুশনারি গার্ডের সাবেক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির বিশালাকার চিত্রটা ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল কাসেম সোলাইমানিকে।
গত ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসানের মধ্যে দিয়ে অন্যতম এক মিত্রকে হারিয়ে ইরান আরও একটি আঘাতের মুখোমুখি হলো। দামেস্কে দূতাবাসে কাসেম সোলাইমানির লন্ডভন্ড চিত্রে যেন সেই আঘাতেরই একটা চেহারা ফুটে উঠছিল।
এই পরিস্থিতিতে ইরান যখন তার ক্ষত প্রশমনের চেষ্টা করছে, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন মেয়াদের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন প্রশ্ন আসে– তারা (ইরান) কি আরও কড়া অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে? না কি পশ্চিমের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসবে? প্রশ্ন কিন্তু এটাও যে তাদের শাসন ব্যবস্থা এই মুহূর্তে ঠিক কতটা স্থিতিশীল?
আসাদ সরকারের পতনের পর প্রথম ভাষণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে বেশ সাহসী অবস্থান নিতে দেখা যায়, যদিও সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে ইরানের জন্য কৌশলগত পরাজয় বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
এদিকে, ১৯৮৯ সাল থেকে দেশ শাসন করে আসা ৮৫ বছর বয়সী খামেনিকে বর্তমানে তার উত্তরাধিকার বেছে নেওয়াকে কেন্দ্র করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। তবে সেই ভাষণের সময় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা দাবি করেন, ইরান মজবুত ও শক্তিশালী আছে। তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
ভাষণে তাকে জোর দিয়ে বলতে শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নেতৃত্বাধীন জোট 'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স' আরও জোরালো হবে।
'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স' হলো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। ইরানের নেতৃত্বে থাকা এই জোটে রয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী ও ইরাকি শিয়া মিলিশিয়ারা।
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে বলতে শোনা যায়, যত বেশি চাপ প্রয়োগ করবেন, প্রতিরোধ ততো শক্তিশালী হবে। যত বেশি নিপীড়ন করবেন, ততটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠবে। যত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন এর ব্যপ্তি ততই বাড়বে।
গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলাকে ইরান সরাসরি সমর্থন না করলেও প্রশংসা করেছিল। এই ঘটনা ওই অঞ্চলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে বর্তমানে অঙ্কটা বদলেছে। শত্রুদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পাল্টা হামলা কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছে যেখানে ইরান অনেকটাই 'ব্যাকফুটে' পিছিয়ে রয়েছে।
সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার জেমস জেফরি এখন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারে কাজ করেন। তার মতে, তাসের ঘরের মতো সব একের পর এক পড়ে যাচ্ছে। ইরানের আক্সিস অব রেজিস্টেন্স ইসরায়েল ভেঙে দিয়েছিল আর সিরিয়ার ঘটনায় তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ছাড়া এই অঞ্চলে কিন্তু ইরানের আর কোনও প্রকৃত প্রতিনিধি নেই।
ইরান এখনও প্রতিবেশী ইরাকের শক্তিশালী মিলিশিয়াদের পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে জেফরির মতে, এটা একটা আঞ্চলিক আধিপত্যের নজিরবিহীন পতন।
সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে শেষবার জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল ১ ডিসেম্বর, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে। সেই সময় সিরিয়ার রাজধানীর দিকে অগ্রসর হওয়া বিদ্রোহীদের 'গুঁড়িয়ে দেওয়ার' প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তবে ছবিটা এই মুহূর্তে ভিন্ন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, দেশ ছেড়ে পালানোর পর আপাতত রাশিয়ায় রয়েছেন বাশার আল-আসাদ।
সিরিয়ায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন আকবরি আসাদকে "অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্সের সম্মুখভাগ" বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আসাদের হঠাৎ পতনের পর ইরানকে তার (আসাদ প্রশাসনের) সমর্থনে যুদ্ধ করতে অসমর্থ ও অনিচ্ছুক বলে মনে হয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই 'অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স'-এ থাকা একমাত্র দেশও ইরানের হাত থেকে ফসকে গিয়েছে।
news24bd.tv/নাহিদ শিউলী